সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভিড়তে পারলেন না মুরাদ জং

ডেস্ক রিপোর্ট : বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ঘেঁষতে পারেননি সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ, সাভারে ধসে পড়া ভবনের মালিক সোহেল রানার ‘মদদদাতা’ হিসেবে গণমাধ্যমে সমালোচিত যিনি। ভবন ধসে আহত এবং ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার কার্যক্রম দেখতে সোমবার সাভার যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমে তিনি আহতদের দেখতে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে মুরাদ আগে থেকে বসে থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢুকতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী ঢোকার পর নিরাপত্তাকর্মীরা হাসপাতালের নিচতলার ফটক আটকে দেয়। ফলে বাইরে থেকে যান মুরাদ জং।
কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডে রানা প্লাজার সামনে চলে যান তিনি। ধ্বংসস্তূপে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে দেখে আওয়ামী লীগ প্রধানকে চোখ ফিরিয়ে নিতে দেখা যায়।

রানা প্লাজার সামনে প্রধানমন্ত্রী গাড়ি থেকে নামার পর সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী উদ্ধার অভিযানে থাকা সেনাবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরকার প্রধানকে পরিচয় করিয়ে দেন। ওই সময় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো সেনা কর্মকর্তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মুরাদ জং। তাকে সেখানে দেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা উষ্মা প্রকাশ করে আরেক কর্মকর্তাকে বলেন, “ও ওইখানে গেল কীভাবে?” উচ্চস্বরে বলা এই কথা শুনে মুরাদ সেখান থেকে সরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়ান।

এরপর রানা প্লাজার বিপরীত দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন উদ্ধার তৎপরতার কথা শুনছিলেন, তখন শেখ হাসিনার দু’পাশে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর সঙ্গে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলাও ছিলেন। মুরাদ তখন একপাশে আওয়ামী লীগের নেতাদের পেছনে দাঁড়িয়ে, শেখ হাসিনাকে সেদিকে একবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিতে দেখা যায়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের পিছু পিছু সাভার সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে গেলেও ঢুকতে না পেরে বারান্দায় ঘোরাঘুরি করে ফিরতে হয় আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্যকে।

গত ২৪ এপ্রিল এই ভবন ধসে প্রায় চারশ’ মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী করা হচ্ছে এর মালিক

সাভারের আওয়ামী লীগ নেতা ও পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফউদ্দিন খান ইমু সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, রানার শ্বশুর ছিলেন সাভার পৌর যুবদলের আহ্বায়ক। মূলত শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়েই সে বিএনপি আমলে মাদক ব্যবসায় আসে। ২০০৯ সালের পর মুরাদ জংয়ের সঙ্গে রানার ঘনিষ্ঠতা হয় বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা জানান। সাভার আওয়ামী লীগের এক নেতা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মুরাদ জংয়ের সব কর্মসূচিতে লোক ‘সাপ্লাই’ দেয়ার দায়িত্ব ছিল রানার। আর সেজন্য রানার সব কাজে মদদ দিয়ে আসতেন সংসদ সদস্য। রানা প্লাজার সামনে থেকে গত কিছু দিন ধরে আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিল শুরু হওয়ার কথা স্থানীয় অনেকেই বলেছেন।

মুরাদ জং ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে জীবনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাভার আসনে দেশের প্রথম সংসদ সদস্য আনোয়ার জংয়ের এই ছেলে দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে ফিরে ২০০১ সালে নির্বাচন করলেও হেরে যান বিএনপি প্রার্থী ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবুর কাছে।  ওই নির্বাচনে শিল্পোদ্যোক্তা হাসিনা দৌলা মনোনয়ন চাইলেও আওয়ামী লীগের টিকিট পান মুরাদ। পরের নির্বাচনেও হাসিনা দৌলাকে হটিয়ে দলীয় টিকিট পান তিনি, নির্বাচিতও হন। মুরাদ জংয়ের ‘আনুকূল্য’ পেয়েই সোহেল রানা সাধারণ অবস্থা থেকে কয়েক বছরের মধ্যে অর্থশালী হয়ে ওঠেন বলে স্থানীয়রা মনে করেন।

বাস স্ট্যান্ডে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে ৫৬ শতাংশ জমির ওপর গড়ে ওঠা রানা প্লাজা ছাড়াও সাভার বাজার রোডে আরেকটি ভবন রয়েছে তার।  একজন হিন্দু ব্যক্তির জমি দখল করে রানা প্লাজা নির্মাণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, এই ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ অনুসরণ করা হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। ভবন ধসের পর রানার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।


সোহেল রানাকে, যুবলীগের এই নেতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ রয়েছে মুরাদ জংয়ের বিরুদ্ধে। ভবন ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর রানার ফাঁসির দাবিতে সাভারে স্বজন হারানোদের যে মিছিল হয়েছে, তাতে স্লোগানে মুরাদ জংয়ের শাস্তিও দাবি করা হয়েছে। তবে ধসের পর থেকে রানা প্লাজার সামনে থাকা মুরাদ জং ভবন মালিক সোহেল রানাকে মদদ দেয়ার সব অভিযোগ নাকচ করে আসছেন।  সাভার পৌর যুবলীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচয়ে কয়েক মাস আগেও সাভার এলাকা পোস্টারে ছেয়ে ফেলেন রানা, যাতে মুরাদ জংয়েরও ছবি ছিল। অবশ্য সোমবারই এই কমিটি বাতিল ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। ফাটল ধরার পরদিন পুলিশের নিষেধ সত্ত্বেও নয় তলা বিশিষ্ট রানা প্লাজায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে ভবনটি ধসে পড়ে। ধসের সময় ভবনের নিচতলায় ছিলেন রানা, তবে ওই অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ধসের পর জনরোষে পড়ার আশঙ্কায় রানা প্রথমে বের হননি। পরে মুরাদ জংসহ যুবলীগের কর্মীরা গিয়ে তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এরপরই পালিয়ে যান তিনি। চার দিন পর রোববার যশোরের বেনাপোলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর রানা সাংবাদিকদের বলেন, মুরাদ জং নয়, স্থানীয়রাই তাকে ভবন থেকে বের করে এনেছিল। রানা সাভারে মাদক চক্রের অন্যতম হোতা বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি বলেন, ধসে পড়া ভবন রানা প্লাজার বেসমেন্টেই ছিল ফেনসিডিলের ‘আড়ত’।